বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত শিল্প। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (GDP) এ খাতের অবদান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বেশ কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে যার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। নিচে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শিল্পের বিবরণ দেওয়া হলো:
পাট শিল্প : ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জে আদমজি পাটকল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাট শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এ দেশে একসময় প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাট বিক্রি করে কৃষক তার পরিবারের টাকার চাহিদা পূরণ করত। একসময় পাটকলগুলো শুধু পাটের বস্তা উৎপাদন করত। এখন পাট দিয়ে নানা পণ্য-সামগ্রী উৎপাদনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হবে।
বস্ত্র শিল্প : ১৯৪৭ সালে এদেশে মাত্র ৮টি বস্ত্রকল ছিল। বর্তমানে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচুর বস্ত্র ও সুতাকল রয়েছে। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কম মূলধন ও অধিক শ্রমিক ব্যবহার করে এ শিল্পের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। শিল্পায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বস্ত্ৰ শিল্পের প্রাধান্য ছিল।
পোশাক শিল্প : সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। গত শতকের আশির দশকে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। অতি অল্প সময়ে এ শিল্পটি দেশের বৃহত্তম রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত হয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় তিন হাজারেরও অধিক পোশাক শিল্প ইউনিট রয়েছে। এতে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করছে। বাংলাদেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে।
চিনি শিল্প : বাংলাদেশে প্রচুর আখের চাষ হয়। আখ থেকে চিনি ও গুড় তৈরি হয়। ১৯৩৩ সালে নাটোরের গোপালপুরে প্রথম চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে দেশে ১৭টি চিনিকল আছে। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী চিনি দেশে উৎপাদিত হয় না। ফলে বাংলাদেশকে প্রতি বছর প্রচুর চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
কাগজ শিল্প : ১৯৫৩ সালে চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী কাগজের কল স্থাপিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এদেশে কাগজ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। স্থানীয় বাঁশ ও বেতকে ব্যবহার করে কাগজ উৎপাদন শুরু হয়। দেশে এখন সরকারি ও বেসরকারিখাতে বেশ কয়েকটি কাগজের কল রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে কর্ণফুলী, পাকশী, খুলনা হার্ডবোর্ড ও নিউজপ্রিন্ট মিল ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে বসুন্ধরা ও মাগুরা পেপার মিল উল্লেখযোগ্য কাগজ শিল্প প্রতিষ্ঠান।
সার শিল্প : কৃষি প্রধান বাংলাদেশে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যেই রাসায়নিক সার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৬১ সালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক সার কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় । দেশে এখন ৮টি সার কারখানা চালু আছে। বাংলাদেশের সারের চাহিদা পূরণের জন্যে এ কয়টি কারখানার উৎপাদন যথেষ্ট নয়। প্রতি বছর বিদেশ থেকে আমাদের প্রচুর সার আমদানি করতে হচ্ছে।
সিমেন্ট শিল্প : পাকা বাড়িঘর, দালান কোঠা তথা শহর নির্মাণে প্রচুর সিমেন্টের প্রয়োজন হয় ৷ চুনাপাথর ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সমন্বয়ে সিমেন্ট উৎপাদিত হয়। ১৯৪০ সালে ছাতক সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এদেশে সিমেন্ট শিল্পের যাত্রা শুরু হয় । বর্তমানে বাংলাদেশে বড় ও মাঝারি আকারের ১২টি সিমেন্ট কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় দেশের মোট চাহিদার অর্ধেক সিমেন্ট উৎপাদিত হয়। বাকি সিমেন্ট আমাদের বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
ঔষধ শিল্প : বাংলাদেশে বর্তমানে ঔষধ একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। এক সময় আমাদেরকে প্রচুর অর্থ খরচ করে বিদেশ থেকে ঔষধ আমদানি করতে হতো। এখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েকটি ঔষধ কোম্পানি তৈরি হয়েছে যারা দেশের ঔষধ চাহিদার অনেকটাই পূরণ করছে, একই সঙ্গে বিদেশে ঔষধ রপ্তানিও করছে। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্প হিসাবে ঔষধের সম্ভাবনার কথা সকলেই এখন গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে।
চামড়া শিল্প : বাংলাদেশে প্রচুর গরু, ছাগল ও মহিষ পালন করা হয়। এদেশে বহু আগে থেকেই চামড়া বা টেনারি শিল্প গড়ে উঠেছে। জুতা ও ব্যাগ তৈরিতে চামড়া শিল্পের জুড়ি নেই। এখন বাংলাদেশে কিছুসংখ্যক চামড়া শিল্প কারখানা তৈরি হয়েছে যেগুলো দেশের গরু, ছাগল ও মহিষের চামড়া থেকে জুতা, ব্যাগসহ নানা উন্নতমানের জিনিস তৈরি করছে। কোনো কোনো কোম্পানি বিদেশেও তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করছে।
চা শিল্প : চা বাংলাদেশের অতি পুরাতন শিল্পের মধ্যে একটি। সিলেট অঞ্চলে প্রচুর চা উৎপাদিত হয়। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ে বর্তমানে চায়ের চাষ হচ্ছে। চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তা পানের উপযোগী করা হয়। বাংলাদেশ নিজেদের চায়ের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করে থাকে।
তুলা : তুলা বাংলাদেশে একটি নতুন অর্থকরী ফসল। বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে তুলার চাষ শুরু হয়েছে। এদেশের জলবায়ু ও মৃত্তিকা তুলা চাষের উপযোগী। তবে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম বলে প্রয়োজনীয় তুলার বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
চিংড়ি : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চিংড়ি মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে বাংলাদেশে চিংড়ি অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্য। তাই চিংড়িকে বাংলাদেশের ‘সাদা সোনা' বলা হয় ।
এছাড়া বাংলাদেশে নানা ধরনের ছোট ও মাঝারি শিল্প রয়েছে। নতুন নতুন শিল্প-কারখানা তৈরি হচ্ছে। ঐসব কারখানা থেকে বিভিন্ন পণ্য-সামগ্রী তৈরি হচ্ছে যা আমাদের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কাজ : বাংলাদেশের শিল্পখাতের তালিকা প্রণয়ন করে এগুলোর গুরুত্ব চিহ্নিত করো।
Read more